দেশের ৪ কোটি মানুষ থাইরয়েডে ভুগছে : আক্রান্তের ৬০ শতাংশ চিকিৎসার বাইরে

 প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৩৯ পূর্বাহ্ন   |   জাতীয়

দেশের ৪ কোটি মানুষ থাইরয়েডে ভুগছে : আক্রান্তের ৬০ শতাংশ চিকিৎসার বাইরে

সোনিয়া আক্তার, বয়স ৩৬ বছর। পরপর তিন বার গর্ভপাত হয়েছে তার। এই অবস্থার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এরপর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে নানা পরীক্ষানিরীক্ষার পর জানতে পারেন সোনিয়া হরমনজনিত সমস্যা ‘থাইরয়েডে’ আক্রান্ত। অন্য একজন নারী জিনাত আরা (৩৮) বলেন, ‘গরমকালে আমার গরম লাগে বেশি, যা অসহনীয়; আবার শীতকালে অন্যদের চেয়ে ঠাণ্ডাও লাগে বেশি। এছাড়া, ওজন বেড়েই যাচ্ছে, কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না।’ 

হঠাত্ করে এমন ক্লান্তি, মেজাজের ওঠানামা, ওজন বেড়ে যাওয়া কিংবা কমে যাওয়া, চুল পড়ে যাওয়ার মতো নীরব পরিবর্তনের পেছনের কারণ—শরীরের ছোট্ট একটি গ্রন্থি ‘থাইরয়েড’। গ্রন্থিটি ছোট্ট হলেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে। নারীর দৈনন্দিন জীবনে কর্মক্ষমতা এবং মানসিক সুস্থতার ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে এই থাইরয়েড।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার তথ্য বলছে—দেশের প্রায় ৪ কোটি মানুষ থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছেন, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের বেশি। থাইরয়েডে আক্রান্তদের মধ্যে প্রতি সাত জনের মধ্যে পাঁচ জনই নারী। আর আক্রান্তদের মধ্যে ৬০ শতাংশই জানা নেই যে তারা এই রোগে আক্রান্ত। অন্যদিকে, প্রতি ২ হাজার শিশুর মধ্যে একজন শিশু জন্মগত থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছে। অন্য একটি স্বাস্থ্য জরিপে দেখা গেছে, দেশের শহর ও গ্রামে বসবাসকারী ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই হাইপোথাইরয়েডিজম বা হাইপারথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত। কিন্তু এদের অনেকেই জানেন না যে তারা এই সমস্যায় ভুগছেন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বয়ঃসন্ধিকালে, নারীদের গর্ভধারণের আগে, শিশুর জন্মের পরে এবং নারীদের বয়স ৪০ হওয়ার পর থাইরয়েড হরমনের পরীক্ষা করা জরুরি। এই তথ্যগুলো জনগণের মধ্যে জানাতে পারলে এবং চিকিৎসার আওতায় আক্রান্তদের আনতে পারলে থাইরয়েডকে আমরা প্রতিরোধ করতে পারব। এছাড়া, আগে ব্যবস্থা নিলেও এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। তারা বলছেন, নিয়মিত চিকিৎসা নিলে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর চিকিৎসা না নিলে থাইরয়েড থেকে হতে পারে ক্যানসার এবং মৃত্যুও।

থাইরয়েড শরীরে কীভাবে কাজ করে :থাইরয়েড গলার নিচে অবস্থিত একটি ছোট আকৃতির গ্রন্থি, যা হরমোন উৎপাদনের মাধ্যমে শরীরের বিপাকীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। এটি মূলত দুই ধরনের হরমোন তৈরি করে। টি-৩ ও টি-৪ যেগুলো শরীরের শক্তি উৎপাদন, ওজন নিয়ন্ত্রণ, তাপমাত্রা, মনমেজাজ এমনকি প্রজনন ক্ষমতার সঙ্গেও সম্পর্কিত।

থাইরয়েড সমস্যার উপসর্গ :থাইরয়েড সমস্যা সাধারণত ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে—হঠাত্ ওজন বাড়া বা কমে যাওয়া, অতিরিক্ত ক্লান্তি, মনমেজাজ খারাপ থাকা, মাসিক চক্রের অনিয়ম, চুল পড়া, গলার সামনে ফোলা ভাব, ঠাণ্ডা বা গরমে অতিসংবেদনশীলতা, স্মৃতিভ্রংশ বা একাগ্রতা কমে যাওয়া।

এন্ডোক্রিনোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. তানজিনা হোসেন বলেন, থাইরয়েড নিয়ে আমরা যতটা ভাবি, এটা তার চেয়েও কমন। আমাদের দেশের অনেক বেশি নারী থাইরয়েডে আক্রান্ত। একটা গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি তিন জন নারীর মধ্যে একজন কোনো না কোনো থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছেন। থাইরয়েড থাকলে তা নানা ধরনের সমস্যা তৈরি করেই, তবে মেয়েদের কিছু বাড়তি সমস্যা তৈরি করে—যেমন, তাদের ফার্টিলিটির ওপর প্রভাব ফেলে। থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে মেয়েদের মাসিকের সমস্যা তৈরি হয়; কারো বেশি হয়, কারো কম হয় এবং কারো বন্ধ হয়ে যায়। আর অনিয়মিত মাসিকের সঙ্গে ডিম্বানুর একটা সম্পর্ক থাকে। ফলে বন্ধ্যত্ব দেখা দিতে পারে।

এছাড়া, গর্ভধারণ করলেও তা অনেক সময় গর্ভপাত হয়ে যায়। তবে এক বা দুই বার গর্ভপাত হলে থাইরয়েড পরীক্ষা করা জরুরি। আর গর্ভপাত না হলেও থাইরয়েড নিয়ে গর্ভধারণ করলেও দেখা যায়, মা ও সন্তানের অনেক ধরনের জটিলতা দেখা যায়। যেমন—মায়ের উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে, সন্তানের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ব্যাহত হতে পারে। এটা পরে বোঝা যায়, যখন শিশু স্কুলে যায়, তখন দেখা যায় পড়াশোনায় শিশুর মনোযোগ কম, ব্রেন ডেভেলপমেন্ট কম হয়, সূক্ষ্ম হলেও পরে সেটা বোঝা যায়। তাই গর্ভধারণের পরিকল্পনা করলে থাইরয়েড পরীক্ষা করে নেওয়া জরুরি এবং গর্ভধারণের পুরো সময়টাতে থাইরয়েড চেকআপে রাখতে হবে—একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে এটা আমাদের চাওয়া।

অধ্যাপক ডা. এ কে এম ফজলুল বারী বলেন, এই রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত না হওয়ায় নীরবে ছড়িয়ে পড়ছে। দেশের উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি থাকলেও অধিকাংশ মানুষ জটিল অবস্থায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। তাই আমাদের লক্ষ্য সারা দেশে থাইরয়েড বিশেষজ্ঞ তৈরি করা এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো। বাংলাদেশে থাইরয়েড এখন এক নীরব স্বাস্থ্য ঝুঁকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। সচেতনতা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা—এই তিন বিষয় মেনে চললে, এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।   


জাতীয় এর আরও খবর: