বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণে পরিবেশগত ঝুঁকিতে পড়েছে বাঁকখালী নদী চ্যানেল

 প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:৪৪ অপরাহ্ন   |   জেলার খবর

বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণে পরিবেশগত ঝুঁকিতে পড়েছে বাঁকখালী নদী চ্যানেল


নুরুল করিম (মহেশখালী, কক্সবাজার) :

কক্সবাজার টু মহেশখালী চ্যানেলের বাঁকখালী নদী ও সাগরের মোহনায় বিমানবন্দর সম্প্রসারণে রানওয়ে ও উড়োজাহাজ উড্ডয়ন-অবতরণে সহায়ক বাতি স্থাপন, অস্থায়ী জেটিসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে বড় ধরনের পরিবেশগত ঝুঁকিতে পড়েছে চ্যানেলটি। মহেশখালী চ্যানেলের মুখে নদীর দিকে প্রস্থের প্রায় ৫৯ শতাংশজুড়ে স্থাপন করা হয়েছে অবকাঠামো। এমনকি অদূরে সোনাদিয়া দ্বীপের জনজীবনও হুমকির মুখে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। শুধু তাই নয়, কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন রুটে নৌ চলাচল ঝুঁকিতে পড়ার শঙ্কাও আছে। এ অবস্থায় চ্যানেলে পাইলিং করে নির্মিত রানওয়ের সহায়ক কাঠামো উচ্ছেদে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। গত বুধবার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠানো বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফার সই করা চিঠিতে এ সুপারিশ করা হয়।


চিঠিতে বলা হয়, বিআইডব্লিউটিএর নিয়ন্ত্রণাধীন কক্সবাজার (কস্তুরাঘাট) নদীবন্দরের বন্দর সীমানাভুক্ত ‘কক্সবাজার বিমানবন্দর রানওয়ে সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় মহেশখালী চ্যানেলের অভ্যন্তরে জেটি ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করায়, নৌ চ্যানেলের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে– মহেশখালী চ্যানেলে রানওয়ে সম্প্রসারণের ফলে মহেশখালী চ্যানেল ও তৎসংলগ্ন নৌপথগুলোতে ভবিষ্যতে কী প্রভাব পড়বে, তার জন্য বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) অর্থায়নে ‘জলবিদ্যুৎ/পলি পরিবহন মডেলিং, প্রবাহ বাধা, পরিবেশগত এবং সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন’ অন্তর্ভুক্ত করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমীক্ষা করা।

এ ছাড়া চিঠিতে কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণের কাজে মালপত্র পরিবহনের জন্য কর্তৃপক্ষের ফোরশোর ভূমি ব্যবহার, মালপত্র লোডিং-আনলোডিং এবং অস্থায়ী জেটি নির্মাণ ইত্যাদি বাবদ বেবিচক থেকে বিআইডব্লিউটিএর অনুকূলে চার কোটি ১২ লাখ ৬৩ হাজার ৮৩৭ টাকা বকেয়া রাজস্ব আদায়ের উদ্যোগ নেওয়ার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে কর্তৃপক্ষের গঠিত কমিটির উল্লিখিত সুপারিশের বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার আয়োজন করার কথা বলা হয়েছে।


কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বেবিচক। শুরুতে ব্যয় ধরা হয় প্রায় এক হাজার ৫৬৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। পরে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ব্যয় আরও ২২৫ কোটি টাকা বাড়ানোর অনুমোদন দেওয়া হয়। নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন হচ্ছে চীনের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চাংজিয়াং ইচাং ওয়াটার ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো (সিওয়াইডব্লিউসিবি) ও চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন-জেভির মাধ্যমে। সমুদ্র চ্যানেলে কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণের এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২১ সালে। পরের বছর প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন বিআইডব্লিউটিএর প্রতিনিধিরা। সেই সময় নৌ চ্যানেলের অভ্যন্তরে রানওয়ে সম্প্রসারণের ধারাবাহিকতায় বাঁকখালী নদী, মহেশখালী চ্যানেলসহ কক্সবাজার নৌরুট বিলুপ্ত ও আশপাশের প্রতিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করেছিল সংস্থাটি।


সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কক্সবাজার বিমানবন্দর ভূমিতে সম্প্রসারণ করতে হলে বিপুল পরিমাণ বেসরকারি স্থায়ী অবকাঠামো, বিশেষ করে হোটেল-মোটেল ভাঙতে হতো। সে ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া এড়িয়ে বেবিচক সমুদ্র চ্যানেলে রানওয়ে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়। এ জন্য নদীবন্দর ও নৌরুটের সংরক্ষক প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিএর মতামত না নিয়েই নদীতীরবর্তী ৬৮২ একর ভূমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

বিষয়টি নিয়ে বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে একাধিকবার শঙ্কা প্রকাশ এবং ফোরশোর ও নদী ব্যবহারের অনুমোদন নেওয়ার চিঠি দেওয়া হলেও তা আমলে নেয়নি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পটির কারণে নদীর নাব্য হারানোর ঝুঁকি তৈরি হলে নৌ চ্যানেলের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করতে বিআইডব্লিউটিএর একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি ২০২৪ সালের ৮ নভেম্বর প্রকল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে।


সংস্থাটির পরিচালক (বন্দর ও নদীবন্দর) এ কে এম আরিফ উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন– অতিরিক্ত পরিচালক (হাইড্রোগ্রাফি বিভাগ) মো. নজরুল ইসলাম, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ড্রেজিং) মো. মিজানুর রহমান ভূঁইয়া ও প্রকৌশল বিভাগের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ এস এম আশরাফুজ্জামান। কমিটির পক্ষ থেকে গত কয়েক মাস আগে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।


এতে বলা হয়, নদীতে পিলার স্থাপন করা হলে স্রোত বাধাগ্রস্ত হয়ে গোড়ায় ধীরে ধীরে পলি জমে চর সৃষ্টির প্রবণতা দেখা যায়। একইভাবে পলি জমে মহেশখালী চ্যানেলের উৎসমুখ বন্ধ বা সরু হয়ে (বাঁকখালী) নদীটি এখন জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে পড়ার পথে। নির্মিত রানওয়ের প্রভাবে এরই মধ্যে চ্যানেলের প্রবেশমুখে নাজিরারটেক অংশে নাব্য সংকট দেখা দিয়েছে। চ্যানেলের এ অংশের বিকল্প হিসেবে সোনাদিয়া দ্বীপ এলাকা দিয়ে নতুন চ্যানেল তৈরি হয়েছে, যাতে নৌপথের দৈর্ঘ্য তিন কিলোমিটার বেড়েছে। বিকল্প চ্যানেলটি এখন ধীরে ধীরে পশ্চিমে সম্প্রসারণ হচ্ছে। এতে সোনাদিয়া দ্বীপের জনজীবন একসময় হুমকিতে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। মহেশখালী চ্যানেলের উৎসমুখের ব্যাপ্তি বেড়ে যাওয়ায় এখন বিস্তীর্ণ অংশ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে পুরো অংশেরই নাব্য কমে গেছে। সব মিলিয়ে এখন নতুন চ্যানেলের আড়াই কিলোমিটার অংশে নাব্য সংকট দেখা দিয়েছে।


এতে আরও বলা হয়, রানওয়ে সম্প্রসারণের কারণে মহেশখালী চ্যানেলের উৎসমুখে পলি জমে কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন রুটে নৌ চলাচল ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। পলি জমে চ্যানেলটি বন্ধ হলে মহেশখালী-কক্সবাজার, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সব নৌপথই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।


প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, সমুদ্রবুকের ওপর ১ হাজার ৭০০ ফুট রানওয়ের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা এবং আন্তর্জাতিক যাত্রী প্রান্তিক ভবন নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় সরকার।

জেলার খবর এর আরও খবর: